সংস্কারের সঙ্গেই নির্বাচন প্রস্তুতি
২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ এএম | আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:৩৫ এএম
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একসাথে চলতে থাকবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ মূলত নির্বাচন কমিশনের। নাগরিকদের নির্বাচনের তারিখ না-পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সময় দিতে হয় না। কিন্তু সংস্কারের কাজে সব নাগরিককে অংশ নিতে হবে। যারা ভোটার তারা তো অংশ নেবেনই, তার সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে ভোটার হবেন তারাও সর্বাত্মকভাবে সংস্কারের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করুন। গতকাল শুক্রবার ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ আয়োজিত ‘ঐক্য, সংস্কার, নির্বাচন’ শীর্ষক জাতীয় সংলাপে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, সংস্কারের কাজটা নাগরিকদের জন্য সহজ করতে আমরা ১৫টি কমিশন গঠন করে দিয়েছি। জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন পেলেই পদক্ষেপ গ্রহণ।
এর আগে নির্বাচন কমিশন থেকে জানানো হয়েছে মার্চ মাসেই নতুন ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। অতঃপর নির্বাচন সংক্রান্ত কার্যক্রম ঘোষণা হবে। ১৭ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ কে এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ‘সরকার চাইলে যেকোনো সময় নির্বাচন করতে প্রস্তুত কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা একটা সময়সীমা ঘোষণা করেছেন। সেই অনুযায়ী আমরা এগোবো। সে অনুযায়ী নির্বাচন কমিশন নিজস্ব একটি কর্মপরিকল্পনা করছে।’ নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, ভেতরে ভেতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নতুন কমিশন। ভোটার তালিকা সংশোধন ও নতুন ভোটার তালিকাভুক্তকরণ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
দেশের ৪৬টি নিবন্ধিত দল হলেও রাজনৈতিক দলের সংখ্যা প্রায় দেড় শতাধিক। এর মধ্যে দেশের রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ বিতাড়িত এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার দালাল জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে কার্যত আইসিইউতে। বিএনপির পাশাপাশি দেশে এখন সাংগঠনিকভাবে বড় দল হচ্ছে জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন। এদের মধ্যে জামায়াত নির্বাচনের সময়সীমা ইস্যুতে শিখিয়ে দেয়া তোতা পাখির মতো একেক সময় একেক বক্তব্য দিচ্ছে। কিন্তু বিএনপি প্রথম থেকেই নির্বাচন ইস্যুতে পরিষ্কার অবস্থান গ্রহণ করেছে। দলটি সংস্কার চাচ্ছে আবার যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। গতকালও দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা বারবার বলছি, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যেটুকু (সংস্কার) দরকার তার শেষে নির্বাচনে যেতে চাই। আমরা নির্বাচনের কথা বলছি কেন?
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতের সহায়তায় দীর্ঘ দেড় যুগ দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটের অধিকারকে পিষে দিয়েছিল। ৫ আগস্টের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গণতন্ত্র এবং জনগণের ভোটের অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চান। তিনি দেশের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে সংস্কার কমিশন গঠন করেছেন। আবার নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ইস্যুতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিকভাবে তিন দফায় সংলাপের আয়োজন করেন। সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী এবং ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রনেতাদের সাথেও সংলাপ করেন। গতকালও রাজধানীর খামারবাড়ির কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশে (কেআইবি) ফোরাম ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ শীর্ষক দুদিনব্যাপী জাতীয় সংলাপের আয়োজন করে। সেখানে দেশের সব রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ, বুদ্ধিজীবী ও পোশাজীবীদের একত্রিত করা হয়। উদ্দেশ্যÑ সংস্কার ও নির্বাচন ইস্যুতে সবার মতামত গ্রহণ। সেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও বিশিষ্টজনরা নিজেদের মতো করে বক্তব্য দিলেও সবার বক্তব্যের মূল বিষয় ছিল গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় জনগণের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করা। সেখানে আলোচকদের অনেকেই বলেছেন, দেশ নিয়ে যে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। নির্বাচনমুখী হলেই সেগুলো কমে যাবে। নির্বাচন যত দেরি হবে, সমস্যা আরো বাড়বে। মূলত সবার মতামতের ভিত্তিতে তিনি অগ্রসর হচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ক্ষমতা গ্রহণের পর জাতীর উদ্দেশে তিনটি ভাষণ দিয়েছেন। সর্বশেষ ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জাতির উদ্দেশে দেয়া দ্বিতীয় ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, নির্বাচনের ট্রেন লাইনে উঠে গেছে। ট্রেন চলতেই থাকবে, ভোট না হওয়া পর্যন্ত থামবে না।
দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি থেকে বলা হয়েছে, বিএনপি প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন চায়। কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যাওয়ার প্রধান ফটক নির্বাচন। বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে আন্তরিক। রাজনৈতিক সংস্কারের চিন্তা থেকেই ২০১৬ সালে ভিশন-২০৩০ এবং ২০২২ সালে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দেয়া হয়েছিল। বিএনপি প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সংস্কার করে নির্বাচনে যেতে চায়। কিন্তু জনগণকে সঙ্গে নিয়ে এই কাজ করতে হবে। তবে জনগণের ওপর কোনো কিছু চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
গতকাল ‘ঐক্য, সংস্কার ও নির্বাচন’ সংলাপে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশের রূপান্তর পর্বে প্রবেশ করার অধিকার অর্জন করেছি। এই রূপান্তর দ্রুত সফলভাবে কার্যকর করার জন্য আমাদের সব শক্তি নিয়োজিত করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে হবে। পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই। আমাদের এই কাক্সিক্ষত রূপান্তরের লক্ষ্য হবে সব ধরনের বৈষম্য অবসানের রাজনৈতিক আয়োজন নিশ্চিত করা, এ দেশে গণতান্ত্রিক ও নাগরিক সমতাভিত্তিক একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ঐক্য আমাদের মূল শক্তি। জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের ঐতিহাসিক মাত্রায় বলীয়ান করেছে। গত পাঁচ মাসে এই ঐক্য আরো শক্তিশালী হয়েছে। গণ-অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধ শক্তি আমাদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করার ক্রমাগত প্রয়াস চালাতে থাকায় আমাদের ঐক্য আরো মজবুত হচ্ছে। ঐক্যের জোরেই এখন আমরা অসাধ্য সাধন করতে পারি। এখনই আমাদের সর্বোচ্চ সুযোগ। এমন অর্থনীতি গড়ে তুলতে হবে যেটি সব নাগরিকের জন্য সম্পদের ও সুযোগের বৈষম্যহীনতার নিশ্চয়তা দেবে। তিনি বলেন, যত নিম্ন আয়ের পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, প্রতিটি নাগরিকের, তিনি নারী হোক, আর পুরুষই হোক তিনি যেন বিনা বাধায় তো বটেই; বরং রাষ্ট্রের আয়োজনে তার সৃজনশীলতা প্রকাশ করে যেকোনো পর্যায়ের উদ্যোক্তা হতে পারেন। অথবা তিনি যে ধরনের কর্মজীবন চান তাই বেছে নিতে পারবেন। তিনি বলেন, এমন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় পরিবেশ থাকবে যেখানে সংখ্যালঘু-সংখ্যাগুরু এই পরিচিতি অবান্তর হয়ে পড়বে। সবার একটিই পরিচয়, আমি বাংলাদেশের নাগরিক এবং রাষ্ট্র আমাকে আমার সব অধিকার দিতে বাধ্য। রাষ্ট্রের কাছে এবং অন্য নাগরিকের কাছে আমার অন্য কোনো পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন হবে না। যেখানে ব্যক্তি বন্দনার কোনো সুযোগ থাকবে না। দেশের ভেতরে বা বাইরে প্রভু-ভৃত্যের কোনো সম্পর্কের সুযোগ থাকবে না। তিনি আরো বলেন, আমরা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে হবো বিশ্ব নাগরিক। দেশের মঙ্গল সাধন করা যেমন হবে আমাদের নাগরিক দায়িত্ব, তেমনি বিশ্বের মঙ্গল সাধন করাও আমাদের কর্তব্য। এ দায়িত্বও আমরা সমানভাবে পালন করব। আমাদের তরুণ-তরুণীরা দ্রুত এই দুই দায়িত্ব সমানভাবে পালন করার জন্য প্রস্তুতি নেবে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সংস্কারের যে দায়িত্ব ঐতিহাসিক কারণে আমাদের কাছে এসেছে, এই দায়িত্ব পালনে আমাদের প্রত্যেককে, প্রতি নাগরিককে, রাজনৈতিক দলকে, প্রতিটি সামাজিক, অর্থনৈতিক, ব্যবসায়িক ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রত্যেককে দৃঢ়তার সাথে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। কে কীভাবে এই মহা গৌরবের দায়িত্ব পালন করবেন, আজ আপনাদের সংলাপে ঘোষণা দিন।
সংস্কার ও নির্বাচনের প্রস্তুতি একই সঙ্গে চলতে থাকবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নির্বাচনের প্রস্তুতির কাজ মূলত নির্বাচন কমিশনের। নাগরিকদের নির্বাচনের তারিখ না-পাওয়া পর্যন্ত এই প্রক্রিয়ায় সময় দিতে হয় না। কিন্তু সংস্কারের কাজে সব নাগরিককে অংশ নিতে হবে। যারা ভোটার তারা তো অংশগ্রহণ করবেনই, তার সঙ্গে যারা ভবিষ্যতে ভোটার হবেন তারাও সর্বাত্মকভাবে সংস্কারের কাজে নিজেদের নিয়োজিত করুন। তিনি বলেন, সংস্কারের কাজটা নাগরিকদের জন্য সহজ করতে আমরা ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করে দিয়েছিলাম। তাদের প্রতিবেদন আমরা জানুয়ারি মাসে পেয়ে যাব। প্রত্যেক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব হলো প্রধান বিকল্পগুলো চিহ্নিত করে তার মধ্য থেকে একটি বিকল্পকে জাতির জন্য সুপারিশ করা। যার যার ক্ষেত্রে সংস্কারের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ কীভাবে রচিত হবে তা বিভিন্ন পক্ষের মতামত নিয়ে সুপারিশমালা তৈরি করে দেয়া, নাগরিকদের পক্ষে মতামত স্থির করা সহজ করে দেয়া। তবে কমিশনের প্রতিবেদনে সুপারিশ করলেই আমাকে-আপনাকে তা মেনে নিতে হবেÑ এমন কোনো কথা নেই। এ জন্য সর্বশেষ পর্যায়ে জাতীয় ঐকমত্য গঠন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
সংস্কার কমিশনগুলো অনেক সুপারিশ তুলে ধরবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি, যার যাই মতামত হোক না কেন আমরা দ্রুত একটি ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত করে সংস্কারের কাজগুলো করে ফেলতে চাই। নির্বাচনের পথে যেন এগিয়ে যেতে পারি সেই ব্যবস্থা করতে চাই।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কুলাউড়ায় পুলিশকে মারধর করে আসামি ছিনতাই
রোববার থেকে নগর ভবনে দাপ্তরিক কাজ করবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় : উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ
গণহত্যার টপ কমান্ডারদের বিচার এক বছরের মধ্যে শেষ হবে: চিফ প্রসিকিউটর
কনস্টাস কাণ্ডে কোহলির দোষ দেখছেন অস্ট্রেলিয়ার বোর্ড প্রধান
চরমোনাই মাদরাসা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প: মাসুম বিল্লাহ
বগুড়ায় বালু ব্যবসায়ী হত্যা, লাশ নিয়ে বিক্ষোভ
মাগুরার শ্রীপুরে জোড়া শিশুর জন্ম
রিক্সা ভ্যানে চলন্ত ট্রাকের ধাক্কায় বাবা মেয়ে সহ নিহত ৩
পদ্মা নদীর ভয়ঙ্কর আগ্রাসনে হুমকির মুখে কুষ্টিয়া-রাজশাহী মহাসড়ক
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে দুর্ঘটনা: চালকসহ গ্রেপ্তার ২
গোপালগঞ্জ আড়াই শ’ বেডের আরএমও জেল -হাজতে
বিপ্লবকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না, প্রয়োজনে আবারও মাঠে নামতে হবে: ধর্ম উপদেষ্টা
সাংবাদিক আনিসুর রহমানের মৃত্যু
নিউজিল্যান্ডের কাছে শ্রীলঙ্কার অবিশ্বাস্য পরাজয়
রাশিয়ার উপর আজারবাইজানের বিমান ভূপাতিতের অভিযোগ : যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিত
ফিরে দেখা ২০২৪: সংস্কারের বছরে মাঠের ক্রিকেটে হতাশা
মানুষ সুন্দর ও কল্যাণের অপেক্ষায় আছে : হাজী ইয়াছিন
সিএনজি স্টেশন খোলা রাখার সময় বাড়ছে
সাবেক এমপি কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসাইন কায়কোবাদ দেশে ফিরেছেন
ঘাটাইলে ইসলামী ব্যাংকের ৪০০তম শাখার উদ্বোধন করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর